পশ্চিমবঙ্গ বাড়িভাড়া আইন, ১৯৯৭ - বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার সুবিধা সহ বিস্তারিত

পশ্চিমবঙ্গ বাড়িভাড়া আইন, ১৯৯৭

tenant law of west bengal

কিছু কথা : গত ১০ই জুলাই ২০০১ তারিখ থেকে পশ্চিমবঙ্গ বাড়িভাড়া আইন, ১৯৯৭ চালু হয়েছে, ১৯৫৬ সালের প্রচলিত বাড়িভাড়া আইন বাতিল করে। এই আইন কলকাতা ও হাওড়া পুরসভা এলাকায় এবং ১৯৯৩ সালের পশ্চিমবঙ্গ পৌর আইনের অধীনে যে সমস্ত পৌর এলাকা আছে সেখানে এই আইন প্রযােজ্য হবে। রাজ্য সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে অন্য কোনাে এলাকা এই আইনের অধীনে আনতে পারেন অথবা কোনাে এলাকাকে এই আইনের আওতায় বাইরে রাখতে পারেন।

১৯৯৭ সালের বাড়িভাড়া আইনের মূল বিষয়  ঃ

১৯৫৬ সালের বাড়িভাড়া আইনে নাগরিক হিসাবে একজন ভাড়াটিয়ার বাসস্থানের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। এই সুবিধা গ্রহণ করে বহু ভাড়াটিয়া বংশ পরম্পরার একটি বাড়িতে বহু বছর অতিবাহিত করত। উচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লেগে যেত। বাড়িওয়ালাদের অনেকদিনের দাবি ছিল যে এমন একটি আইন, যার সাহায্যে ভাড়া,উচ্ছেদ ইত্যাদি সমস্যার বিষয়গুলি দ্রুত সমাধান হয় এবং তারাও যেন কোনােভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন। সেইজন্য ১৯৫৬ সালের আইনটি পরিবর্তন করে এই নূতন বাড়িভাড়া আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। নূতন আইনে বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার সমস্যা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি ন্যায়নিষ্ঠ (ট্রাইবুন্যাল) গঠনের কথাও বলা হয়েছে। বাড়িভাড়া দেওয়া বা নেওয়ার চুক্তি । আইনে এ বিষয়ে কিছু বলা নেই—এটি বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়ার নিজস্ব ব্যাপার। যারা এইভাবে চুক্তি করে ভাড়া গ্রহণ করেন তাদের বলা হয় অনুমতি পত্রের অধিকারী (lieansee)। 

সাধারণতঃ ভাড়াটিয়াদের আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যেই বাড়িওয়ালা এই ধরনের চুক্তি করেন। তবে এইসব চুক্তিও নূতন ভাড়াটিয়া সুরক্ষা আইনের উর্ধ্বে নয়। যে কোনাে অবস্থায় যে কোনাে পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে অপর পক্ষ নূতন আইন অনুযায়ী মামলা করতে পারেন। তবে ভাড়াটিয়া বাড়ি ছাড়তে নারাজ হলে জোর করে বাড়িওয়ালা কিছু করতে পারবেন না, আইনের সাহায্য নিতে পারবেন। তবে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি (২৪ বছরের বেশী) ভাড়াটিয়া আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে না। তা ছাড়া মেয়াদ হবার আগে বাড়িওয়ালার যদি ঘরের ন্যায়সঙ্গত প্রয়ােজন’ (reasonable requirement) হয় তা হলে তিনি ভাড়াটিয়াকে বাড়ি ছেড়ে উঠে যেতে বলতে পারেন, অবশ্য ভাড়াটিয়া এই ব্যাপারে নিয়ন্ত্রকের কাছে কোনাে অভিযােগ করলে নিয়ন্ত্রক এই বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানবেন যে বাড়িতে কত ঘর আছে, বাড়িওয়ালার সত্যিই কোনাে ঘরের প্রয়ােজন আছে কি না ইত্যাদি।

মামলার প্রতিবেদন বের হবার আগে কোনাে পক্ষের মৃত্যু হলে তার উত্তরসূরি প্রতিবেদনের সুযােগ নিতে পারেন। অন্যপক্ষকে সেই প্রতিবেদন মান্য করে চলতে হবে। 


নূতন বাড়িভাড়া আইনের বৈশিষ্ট্যঃ 

আর্থিক ভাবে সমাজের দুর্বল শ্রেণীর মানুষের স্বার্থ রক্ষাই পশ্চিমবঙ্গ বাড়িভাড়া আইনের মুখ্য উদ্দেশ্য। সেইজন্য এই আইনেআবাসিক ভাড়াটিয়ার ক্ষেত্রে

(ক) কলকাতা ও হাওড়া পুরসভাভুক্ত এলাকায় বাড়িভাড়া যখন মাসিক ৬,৫০০ টাকা বা কম সেখানে এই আইন প্রযােজ্য। অন্যথায় ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।

(খ) অন্যান্য এলাকায় বাড়িভাড়া যখন মাসিক ৩০০০ টাকা বা তার কম তখন এই আইন প্রযােজ্য। অন্যথায় ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন দ্বারা এটি নিয়ন্ত্রিত হবে। অনাবসিক (বাণিজ্যিক) ভাড়াটিয়ার ক্ষেত্রে(ক) কলকাতা ও হাওড়া পুরসভাভুক্ত এলাকায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে মাসিক ১০,০০০ টাকা বা তার কম হলে এই আইন প্রযােজ্য। অন্যথায় ১৮৮২ সালে সম্পত্তি হস্তান্তর আইন দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হবে।

(গ) অন্যান্য এলাকায় মাসিক ৫০০০ টাকা বা তার কম ভাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে এই আইন প্রযােজ্য। অন্যথায় ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হবে। এর ফলে সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৬নং ধারানুযায়ী ১৫ দিনের নােটিশে ভাড়াটিয়া স্বত্ব খারিজ করা যাবে। পূর্ববর্তী বাড়িভাড়া আইনে এই রকম কোনাে বিধান ছিল না।

নূতন আইনে ভাড়াটিয়ার সুবিধাঃ

(১) বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে শুধুমাত্র ন্যায্য ভাড়ার টাকা দাবি করতে পারেন। ভাড়ার টাকা ছাড়া কোনাে অধিমূল্য, নবায়ন মূল্য বা অন্য কোনাে অজুহাতে নগদ টাকা বা দ্রব্য, দাবি অথবা গ্রহণ, দণ্ডযােগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু নিয়ন্ত্রকের পূর্বানুমতি নিয়ে বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে এক মাসের ভাড়ার টাকা বেশি নয় এই রকম টাকা অগ্রিম হিসাবে গ্রহণ করতে পারবেন, কিন্তু কোনাে সেলামি, দর্শনী বা অগ্রিম হিসাবে ইচ্ছামত টাকা গ্রহণ করতে পারবেন না।

(২) বাড়িভাড়া প্রদানের জন্য আসবাবপত্র বিক্রয়ের শর্ত আরােপ করা যাবে না। ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে ভাড়া নেবার সময় বাড়িওয়ালা অথবা তার নির্বাচিত প্রতিনিধি ভাড়ার রসিদ দেবেন, রসিদ না দিয়ে ভাড়া গ্রহণ করা অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। বাড়িওয়ালা বাড়িটিকে বসবাসযােগ্য রাখবার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ অর্থাৎ নিয়মিত মেরামতি ও প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা দ্বারা বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ অপারগ হন তখন ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রকের অনুমতি নিয়ে নিজের খরচে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবেন এবং খরচের টাকা প্রদেয় ভাড়া থেকে বাদ দিতে পারবেন। 

(৩) কোনাে ভাড়াটিয়া মারা গেলে তার পরিবারবর্গ যারা মৃত ভাড়াটিয়ার সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করছিলেন ন্যায্য ভাড়া দিয়ে তারা পাঁচ বছর পর্যন্ত ঐ বাড়িতে বাস করতে পারবেন। বাড়িওয়ালার অনুমতি নিয়ে ভাড়াটিয়া উপ-ভাড়া দিতে পারবেন এবং বাড়িওয়ালার অনুমতি না নিয়ে তার অংশে বিদ্যুৎ সংযােগ নিতে পারবেন। মেরামত বা নির্মাণ বা পুননির্মাণের অজুহাত দেখিয়ে বাড়িওয়ালা বাড়ির দখল নিয়ে অযথা ফেলে রাখতে পারবেন না কিংবা মেরামত নির্মাণ বা পুননির্মাণ যাই হােক না কেন চুক্তি অনুযায়ী ভাড়াটিয়াকে না দিয়ে অন্য কাউকেও দখল দিতে পারবেন । তা দণ্ডযােগ্য অপরাধ।

(৪) বাড়িওয়ালা ভাড়া গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে ঐ ভাড়া ডাকযােগে মানিঅর্ডার করে ভাড়া দেওয়া যাবে। যদি বাড়িওয়ালা মানিঅর্ডারের টাকা গ্রহণ না করেন তখন ঐ বাড়িভাড়ার টাকা নিয়ন্ত্রকের কাছে জমা দিতে হবে। 


নূতন আইনে বাড়িওয়ালার সুবিধাঃ

(১) ভাড়াটিয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাড়িওয়ালাকে অথবা তার নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ভাড়া দেবেন। যে উদ্দেশ্যে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র সেই উদ্দেশ্যেই ভাড়াটিয়া তা ব্যবহার করবেন, অন্য কোনাে উদ্দেশ্যে নয়।

(২) বাড়িওয়ালার লিখিত সম্মতি ছাড়া ভাড়াটিয়া বাড়ির কোনাে অংশ পরিবর্তন। বা সংযােজন করতে পারবেন না অথবা কোনাে অংশ উপ-ভাড়া দিতে পারবেন না বা কোনাে অংশের দখল হস্তান্তর করতে বা ন্যস্ত করতে পারবেন না।

(৩) নােটিশে বর্ণিত সময়ে বাড়ির যে কোনাে অংশে প্রবেশ পরিদর্শন করবার সুযোেগ বাড়িওয়ালা পাবেন। ন্যায্য ভাড়া যা স্থির হবে তার দশ শতাংশ হারে স্বাচ্ছন্দ্য খরচ বাবদ অতিরিক্ত টাকা ভাড়াটিয়াকে দিতে হবে। প্রত্যেক ভাড়াটিয়া পৌর আইন অনুযায়ী ভােগদখলকারী রূপে তার অংশের জন্য পৌর কর প্রদান করবেন।

(৪) বাড়ির দখল পরিত্যাগ করা বা হস্তান্তর করার জন্য ভাড়াটিয়া, বাড়িওয়ালার কাছ থেকে কোনাে রকম অর্থ দাবি করতে পারবেন না। যখন বাড়িওয়ালা সরকারি কর্মচারী বা অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী বা সেনা, নৌসেনা বা বিমানবাহিনীর অব্যবহিতপ্রাপ্ত বা অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী তখন তিনি তাৎক্ষণিক বাড়ি উদ্ধার করার অধিকারী।

(৫) বাড়ির ন্যায্য ভাড়া এবং বৃদ্ধি বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক প্রবৃদ্ধি করা যাবে। ভাড়াটিয়া আইন অমান্য করে উপ-ভাড়া প্রদান করলে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হবে।


ভাড়াটিয়া উচ্ছেদের কারণ :

নিম্নলিখিত কারণগুলি ভাড়াটিয়া উচ্ছেদের জন্য প্রযােজ্য 

(১) ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৮ ধারার (৬); (১) এবং (৩) প্রকরণে বর্ণিত বিধানানুযায়ী প্রতিকূল কোনাে কাজ করলে; 

(২) যখন ভাড়াটিয়া অর্থনৈতিক বা অবৈধ কাজে বাড়িটি ব্যবহার করে;

(৩) যখন ভাড়াটিয়া বাড়িটির ক্ষতির জন্য দায়ী হয় বা ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়ির ক্ষতিসাধন করে;

(৪) বাড়িওয়ালার লিখিত সম্মতি ছাড়া যখন ভাড়াটিয়া উপ-ভাড়া প্রদান করে;

(৫) যখন ভাড়াটিয়া বা তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি দশমাস পর্যন্ত বাড়িটি ব্যবহার করে তালাবন্ধ করে রাখে;

(৬) যখন ভাড়াটিয়া কোনাে বাড়ি অথবা ফ্ল্যাট কেনেন বা তার নামে বরাদ্দ হয় অথচ তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে উঠে না যান;

(৭) যখন ভাড়াটিয়া উৎপাত সৃষ্টি করেন বা বাড়িওয়ালা বা প্রতিবেশীদের উপদ্রব করেন;

(৮) যখন বাড়িওয়ালার নিজের অথবা যার স্বার্থে বাড়িটি করা হয়েছে তার ভােগদখলের যুক্তিসঙ্গত কারণে আবশ্যক হলে; এবং

(৯) যখন মাসিক ভাড়াটিয়া ১২ মাসের মধ্যে তিন মাসের ভাড়া দিতে ব্যর্থ হন। অথবা যখন মেয়াদী ভাড়াটিয়া তিন বছরের মধ্যে তিনি বার ভাড়া দিতে ব্যর্থ হন।

নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা :

নূতন আইনে নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রকের আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করতে হলে ন্যায়পীঠ স্থাপন হলে ন্যায়পীঠে এবং যতদিন না পর্যন্ত ন্যায়পীঠ স্থাপিত হয় ততদিন উচ্চ আদালতে।

পশ্চিমবঙ্গ বাড়িভাড়া আইন, ১৯৯৭ - বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার সুবিধা সহ বিস্তারিত পশ্চিমবঙ্গ বাড়িভাড়া আইন, ১৯৯৭ - বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার সুবিধা সহ বিস্তারিত Reviewed by Wisdom Apps on জানুয়ারী ১৬, ২০২২ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.